আমি যখন শিক্ষক ছিলাম মোহাম্মদ আইয়ুব (৮ম অংশ)
অষ্টাদশী সুরূপা শর্মিলার সাথে আমার দেখা ১৯৯৯ সালে। একটি এনজিও’র চাকরির ইন্টারভিয়ো বোর্ডে। এনজিওটির হেড অফিস ছিল কুমিল্লায়। জসিম উদ্দিন চাষী কো-অর্ডিনেটর, সাঈদ (বর্তমানে প্রয়াত) এ্যাসিস্ট্যান্ট কো-অর্ডিনেটর, খোরশেদ ও জাহাঙ্গীর সুপারভাইজার আর আমি ছিলাম থানা কো-অর্ডিনেটর।
শর্মিলা আর আমি একই এলাকার হলেও বছর পাঁচেক পর দেখা। সেদিনের কিশোরী শর্মিলা আজ রূপ-লাবণ্যে পূর্ণযৌবনা কামিনী।
চাকরি প্রার্থীদের সাক্ষাৎকার শেষে বোর্ড সদস্যগণ রেজাল্ট শিট তৈরি করছেন। প্রার্থীগণ রেজাল্টের অপেক্ষায়।
খোরশেদ আর আমি পাশের কক্ষে বসে কে কে নির্বাচিত হতে পারে, মন্তব্য করছি। একপর্যায়ে আমি শর্মিলার রূপের শরবিদ্ধ হয়ে তার প্রতি অনুরাগসঞ্চারের কথা বন্ধু খোরশেদের নিকট ব্যক্ত করলাম। সে শোনার পর কিয়ৎক্ষণ মৌনাবলম্বনে থেকে নৈয়ায়িকের মতো আমাকে সতর্কবাণী শোনাল।” খবরদার একই এলাকার কোনো মেয়ের সাথে বিষয়াসক্তিতে জড়ানোর সামান্যতম চিন্তাও মাথায় আনবে না। প্রকাশ পেলে মহাকেলেঙ্কারি রটে যাবে। তখন চাকরি তোমারটাতো যাবেই, সাথে আমারটাও”।
বন্ধু খোরশেদ আমার সাতিশয় মঙ্গলের জন্য নিরুৎসাহিত করল, নাকি নিজেও শর্মিলার অতিশয় লাবণ্য সন্দর্শনে, রূপার্ণবে নিমগ্ন হয়ে অধোবদনে আমাকে প্রবঞ্চনাকর প্রবোধবাক্য শোনাল, বুঝতে পারলাম না।
শর্মিলার প্রতি আমার প্রবল অনুরাগ সৃষ্টি হলেও তার পিতা হাজি সাহেবের সাথে আমার সম্পর্ক ছিল চরম বৈরিভাবাপন্ন।
১৯৯৪ সাল। দশম শ্রেণিতে পড়ি। এপ্রিল – মে মাসে স্কুল বন্ধ। অগ্রজদের এস এস সি পরীক্ষা চলছে। স্কুল বন্ধ থাকায় সময় কাটে না। প্রায় প্রতিদিন দুপুর বেলা কোমরে একটি গুলতি গুজে কোচ্চায়(লুঙ্গির কাছায়) মার্বেল নিয়ে সহপাঠী মনু মিয়া সহ বনে বাঁদাড়ে পাখি শিকার করতাম। মাঝেমধ্যে মনুূদের বাড়ির আঙ্গিনায় বসে দাবা খেলে অথবা মনুর বাপের পুঁথি পাঠ শুনে সময় কাটাতাম।
যথারীতি একদিন মনুদের উঠানে বসে মনুর সাথে দাবা খেলছিলাম। মনুদের পাশেই শর্মিলার বাড়ি। শর্মিলাদের বাড়ির আঙ্গিনার একটি মাঝারি আকারের আম গাছে থোকা থোকা আম ধরেছে। প্রতিটি ডাল আমের ভারে ন্যুয়ে আছে। প্রতি থোকায় ১০/১৫ টি করে আম। একটি কাঠবিড়ালি আমের থোকায় ঝুলে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে আম নষ্ট করছিল। আমি মনুকে বললাম, কাঠবিড়ালিটি মারব। মনু বলল দেখি তোমার নিশানা কেমন। তখন কাল বিলম্ব নাকরে গুলতি বের করে নিশানা ঠিক করলাম। আমের থোকার সাথে ঝুলন্ত কাঠবিড়ালিবধে গুলতিযোগে বড় একটি মার্বেল নিক্ষেপ করলাম। নিমিষেই ১০/১৫ টি আম ও কাঠবিড়ালি সমেত থোকাটি শর্মিলাদের উঠানে পড়লো। শর্মিলার বাবা-মা, ভাই-বোন সবাই একসাথে ঘর থেকে বের হলো। হাজি সাহেব ছাড়া সবাই কাঠবিড়ালির পলায়নদৃশ্য উপভোগ করছে। তাদের ধারনা কাঠবিড়ালির কারণে আম গুলো ঝরে পড়েছে। কিন্তু হাজি সাহেব বুঝেছেন, মনু আর আমি ঢিল মেরেছি। তিনি আমি আর মনুকে উদ্দেশ্য করে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ শুরু করলেন।
আমরা বলার চেষ্টা করলাম কাঠবিড়ালিহননে গুলতি ছুড়েছি। কে শুনে কার কথা।তিনি বিরামহীন গালি দিয়েই যাচ্ছেন। তার গালির বচনীয়তা আর প্রতিটি বাক্যের অন্তর্নিবিষ্ট ভাবের উদ্দিষ্ট অনুধাবনে আমার যেটি মনে হলো, হাজি সাহেব গালি বিদ্যায় অগাধ পাণ্ডিত্য অর্জন করেই দেশে ফিরেছেন।
মনুর বাবা মাকেও কাঠবিড়ালি বধের কিচ্ছা বিশ্বাস করাতে পারলাম না। তারাও আমাদের এই বলে বকা দিলেন, এই অজাতের গাছে কেন ঢিল ছুড়তে গেলে।
শর্মিলার বাবা গাল পাড়তে পাড়তে আমার বাড়িতে গিয়ে মাকে নালিশ করল, আপনার ছেলে আর সওদাগরের ছেলে মনু আমার এক গাছ কাঁচা আম পেড়ে নষ্ট করেছে। ছেলকে শিক্ষা দিতে না পারলে——ইত্যাদি ইত্যাদি। মা বলল, আসুক,আমি শাসন করব।
বিকেলে মা আয়াজ বদ্দাকে ডেকে এনেছে। আয়াজ আমার মামাতো ভাই। পুরো নাম আইয়ুব কামাল আয়াজ। তখন কক্সবাজার সরকারি কলেজে স্নাতক শ্রেনিতে পড়তেন। বর্তমানে আমেরিকা প্রবাসী। আমরা আয়াজ বদ্দাকে জমের মতো ভয় পেতাম। বদ্দা হুঙ্কার দিয়ে বলল, তোমাদের ভিটায় রাজ্যের আম গাছ। হাজির গাছের আম পেড়ে গোষ্ঠী শুদ্ধাকে গালি শোনাইলা কেন? আমি উত্তর দেওয়ার আগেই কষে এক চড় দিয়ে বলল, আর জীবনে কারো ভিটার গাছে ঢিল ছুড়বে?
-না।
ঠিক আছে।
ফুইন্না (ফুফু), আর কেও কখনো নালিশ দিলে আমাকে খবর দিবে। আয়াজ বদ্দার শাসনের পর মা’র আরেক দফা উপদেশ শুনলাম।
রাতে পড়তে বসলাম। হঠাৎ দেখি আয়াজ বদ্দা হাজির। মনে মনে বলি আবার কী করলাম।
এসেই, পড়তেছ?
-জি।
দেখি এই অঙ্কটি করে দেখাও বলে, একটি সরল অঙ্ক করতে দিলেন। আমি অঙ্কটি মুহুর্তের মধ্যে করে দেখালাম। তখন আয়াজ বদ্দা মাকে ডেকে বলল- ফুইন্না, তাকে মারা আমার ঠিক হয় নাই। সে তো দেখি পড়া-লেখায় খুব ভালো। এই কথা বলে পকেট থেকে দুই প্যাকেট বিদেশি সুইমগাম আমার হাতে দিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, এমন কোন কাজ করো না, যাতে মানুষ গালি দেয়, খারাপ বলে। মনোযোগ দিয়ে পড়, বলেই চলে গেল। তাইতো শাস্ত্রকাররা বলে গেছেন, শাসন করা তারই সাজে, সোহাগ করে যে।
শর্মিলার বাবা হাজি সাহেবের বাংলা, আরবি এবং রাখাইন ভাষার সংমিশ্রণে অতি পাণ্ডিত্যপূর্ণ গালি বাক্য শ্রবণ আর আয়াজ বদ্দার চড়ের ক্লেশ কোন ভাবেই মন থেকে তিরোহিত করতে পারছি না। ক্রমেই প্রতিশোধের দাবানল প্রজ্বলিত হচ্ছে।
পরেরদিন বন্ধু বশর ও মাকসুদ সহ মন্ত্রণায় বসলাম। বশরের প্রস্তাব- হাজি সাহেবের তিন দরজায় তিনটি মহিষের দইয়ের হাঁড়ি নিক্ষেপ করা যেতে পারে।
আমার কাছে এটি উত্তম মন্ত্রণা মনে হলেও মাকসুদ এটির বিরোধিতা করে বলল, “এটি অতি সেকেলে কর্ম।একেবারেই অশিক্ষিত সমাজের কাজ। দেশ এখন জ্ঞান-বিজ্ঞানে অনেক এগিয়ে। অন্য কিছু ভাব”।
বিষদ আলোচনার পর সর্বসম্মতিক্রমে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলাম যে, হাজি সাহেবের আম গাছের মূলোচ্ছেদ করা হবে। এমনভাবে কর্তন করব, সময় ব্যয় হবে কম, আওয়াজও হবে না। এই কার্যসিদ্ধির জন্য তিন জনের মধ্যে দায়িত্ব বন্টিত হলো।
বশর হাজি সাহেবের বাড়ির বিশ্বস্ত কুকুরটি বশীকরণের কৌশল বের করবে।
মাকসুদ একটি ইলেকট্রিক করাত যোগাড় করবে। আর আমার উপর দায়িত্ব অর্পিত হলো- হাজি সাহেবের পরিবারের আদ্যোপান্ত আবিষ্কার করা।
অভিযানের দিন ধার্য করা হলো ২ মে রাত্রির তৃতীয় প্রহর অর্থাৎ ৩মে ১৯৯৪ খ্রিস্টাব্দ।
হতে সময় মাত্র সাত দিন।
বশর বইয়ের দোকান থেকে দুইটি পুস্তক কিনেছে। একটি বশীকরণ বিদ্যার অন্যটি মৃতসঞ্জীবনী বিদ্যার। কুকুরকে বশীভূত করতে গিয়ে যদি ভুল মন্ত্রবলে মৃত্যু হয় তবে মৃতসঞ্জীবন মন্ত্র পাঠে পুনরুজ্জীবিত করতে হবে।
হাজি সাহেব সৎকুলোদ্ভব নাকি অসৎকুলজাত তা অনুসন্ধান করতে গিয়ে আমি যা জানতে পারলাম-
হাজি সাহেবের আদিবাস রাখাইন রাজ্যে। তিনি জীবিকার্জনে মধ্যবয়সে মধ্যপ্রাচ্যে পাড়ি জমান। মধ্যপ্রাচ্য থেকে স্ব-ভূমিতে ফিরতে না পেরে ৭০ এর দশকের শেষের দিকে উখিয়াতে অধিবেদন করেন(অধিবেদন – প্রথম স্ত্রী জীবিত থাকা সত্ত্বেও পুরুষের দ্বিতীয়বার বিবাহ)। অধিবিন্নার (জীবিত প্রথম পত্নীর) তিন সন্তান। জ্যেষ্ঠা কন্যার নাম আয়েশা হেতু পরিবারের সমবয়সীরা এবং প্রতিবেশীরা আশার বাপ বলে ডাকতো। আশার জন্মের পর থেকে অধিবিন্না পরম ভালোবাসায় স্বামীকে আশার বাপ বলে সম্বোধন করতো।
অধিবেদনের পর অধিবিন্না তার প্রিয় পতিকে আশার বাপ বুলাইলে কিছুটা মনোক্ষুন্ন হতো। পরে তিনি জানতে পারলেন তার স্বামী উখিয়াতে আরেকটা বিয়ে করেছে। তার দ্বিতীয় ভার্যার নাম আয়েশা।
অনন্তর আশার জন্মের পর থেকে প্রিয়তম স্বামীকে করা মধুর সম্বোধন ” আশার বাপ” ডাকা বন্ধ করে দিলেন।
আশির দশকের শুরুর দিকে নাফ নদীতে নৌকা ডুবিতেে অধিবিন্না ও অধিবিন্নার পুত্রসন্তানের সলিলসমাধি হলে হাজি সাহেব দুই কন্যাকে পাত্রস্থ করে দ্বিতীয় স্ত্রী আয়েশাকে নিয়ে আবারো মধ্যপ্রাচ্য পাড়ি জমান। সেখানে শর্মিলারা চার বোন এক ভাইয়ের জন্ম হয়। নব্বই ‘র দশকের গোড়ার দিকে সৌদিআরব থেকে স-পরিবারে ফিরে মনুদের বাড়ির পাশে জমি কিনে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে।
বশীকরণ বিদ্যার পুস্তকটি একাধিকবার পাঠ করে কুকুর বশীভূত করার কোন মন্ত্র পায় নাই। সব মন্ত্র মানুষ বশীকরণের।
বশীকরণ বিদ্যা রপ্ত করায় পরবর্তীতে এটি তাকে বেশ সম্মানিত করেছিল। কারো স্ত্রী স্বামীর বশীভূত না হলে কিংবা কোনো স্বামী স্ত্রীর বশীভূত না হলে বশরের শরণাপন্ন হয়। বশর তার রপ্ত করা বশীকরণ বিদ্যার প্রভাবে ফলদায়ক সমাধান দেয়। কোনোটি বিফল হয় নাই। তবে নিজ স্ত্রীকে আজ অবধি বশীকৃতা করতে পারে নাই। ফলে বশর ঘর থেকে বাহিরে যাওয়ার সময় স্ত্রীর মোবাইলের সিম টি খুলে পকেটে পুরে নিয়ে যেতে কখনো ভুলে না।
কুকুর বশীকরণের কোন মন্ত্র না পেয়ে বশর নিজে একটি ফরমুলা আবিষ্কার করে। সেটি হচ্ছে- ইঁদুর মারার ঔষধ বিক্রেতার কাছ থেকে দুই টাকা দিয়ে ৩২ টি সুঁই কিনে নেয়। কালুর দোকান থেকে এক টাকায় ৪টি মুড়ির মোয়াও কিনল। এই হলো তার আবিষ্কৃত ফরমুলার উপকরণ। প্রতিটি মোয়ায় ৮টি করে সুঁই এলোপাথাড়ি বিদ্ধ করে কুকুরকে খেতে দিলেই কুকুরের ঘেউঘেউ নিশ্চিত বন্ধ হবে।
বশর তার আবিষ্কৃত ফরমুলায় তৈরি প্রতিষেধক একটি বিড়ালকে খাওয়ানোর মাধ্যমে পরীক্ষামূলক প্রয়োগ করতে চেয়েছিল কিন্তু মাকসুদ রাজি হয় নাই। অভিযানের দিনই ব্যবহার হবে।
মাকসুদের দায়িত্ব যথাযথভাবে প্রতিপালিত হয়েছে। এখন কেবল মে মাসের ২ তারিখের রজনীর অপেক্ষা।—[চলবে]
লেখক-
মোহাম্মদ আইয়ুব
লালমাই থানা, কুমিল্লা।
তারিখ- ১৬/০৩/২০২২ খ্রিঃ
আপনার মতামত লিখুন :