মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ড কুমিল্লা’র নবনিযুক্ত চেয়ারম্যান ও কুমিল্লা সরকারি মহিলা কলেজের সদ্য বিদায়ী অধ্যক্ষ মোঃ জামাল নাছের’কে বিদায় সংবর্ধনা জানিয়েছেন কুমিল্লা সরকারি মহিলা কলেজ প্রশাসন, শিক্ষক-শিক্ষিকা, কর্মকর্তা ও কর্মচারীবৃন্দ। বৃহস্পতিবার (২৯ সেপ্টেম্বর) বিকেলে শিক্ষক পরিষদ অডিটোরিয়ামে এ বিদায় সংবর্ধনার আয়োজন করা হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ প্রফেসর হাসনাত আনোয়ার উদ্দিন আহমেদ।
জামাল নাছের এর বিদায়ে কুমিল্লা সরকারি মহিলা কলেজ সহকর্মীদের মধ্যে অভিভাবক হারানোর শূন্যতা, এক সাথে কাজ করার অভিজ্ঞতা, একজন প্রতিষ্ঠান প্রধান ও সংগঠক হিসেবে কেমন ছিলেন তার কিছুটা চিত্র সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তুলে ধরেছেন দুই সহকর্মী।
একজন কুমিল্লা সরকারি মহিলা কলেজ বাংলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক রীতা চক্রবর্তী: “একজন মহানায়কের প্রস্থান” শিরোনামে তিনি লিখেছেন– প্রফেসর মো. জামাল নাছের আর কুমিল্লা সরকারি মহিলা কলেজ একই সূঁতোয় গাঁথা। মহিলা কলেজের প্রতিটি ইট, বালু, সিমেন্ট জানে জামাল নাছের কতটা মায়ায় কতোটা যত্নে এই কলেজটিকে আগলে রেখেছেন। যিনি চাকরী জীবনের প্রতিটা স্তরে এই কলেজে চাকরিই শুধু করেন নি, যিনি প্রতিটি মুহুর্তে এই কলেজকে ধারণ করেছেন। অধ্যক্ষ হয়ে এই কলেজে আসার পর স্বপ্নদ্রষ্টা এই মানুষটি এই কলেজকে একটি মডেল কলেজে রূপ দিতে হাতে নিয়েছিলেন কিছু চমকপদ প্রজেক্ট। কলেজকে পরিস্কার পরিছন্ন করে তোলার সাথে সাথে ছাত্রীদের নিয়মিত উপস্থিতি নিশ্চিত করার জন্য সহকর্মীদদের সাথে নিয়ে নিত্য নতুন প্ল্যান করতে থাকেন। হঠাৎ করেই কলেজে ছাত্রী উপস্থিতি বেড়ে যাওয়ায় ক্লাসরুম সংকট দেখা দেয়। নিজ উদ্যোগে নিজ অর্থে কলেজের প্রশাসনিক ভবনের চতুর্থ তলায় ক্লাস রুম নির্মাণের কাজ শুরু করেন তিনি। কলেজের প্রতিটি সহকর্মী উনার নির্দেশ পেলেই প্রবল আগ্রহে ঝাপিয়ে পড়তেন উনার স্বপ্ন বাস্তবায়নে। কারণ প্রতিটি সহকর্মীর তিনি একজন প্রিয় অভিভাবক। ৭০০০ ছাত্রীর তিনি শুধু প্রিয় অধ্যক্ষই নন। কারো কাছে তিনি প্রিয় বাবা, কারো প্রিয় বড় ভাই, আবার অধিকাংশেরই স্বপ্নপুরুষ তিনি। ফেইসবুকের এই দুনিয়ায় তিনি অধিকাংশ ছাত্রীরই ফেইসবুক বন্ধু । যারা অনায়াসে নিজের সুখ-দুঃখ ও সমস্যার কথা উনার সাথে নির্ভয়ে শেয়ার করেন। অধ্যক্ষ মহোদয়ের টেবিলের একটি বিশেষ ড্রয়ার ছিল যেখান থেকে কখনো ছাত্রীদের জন্য চকলেট কখনো ছাত্রীর কলেজ ইউনিফর্ম কেনার টাকা, কখনো ফরম ফিলাপের টাকা, কখনো বই কেনার টাকা আসতো। করোনার করাল থাবা হঠাৎ থমকে দেয় গোটা বিশ্বের মতো একজন জামাল নাছেরের স্বপ্নকেও। কিন্তু প্রতিকুলতায়ও স্বপ্নদ্রষ্টা নিজের স্বপ্ন তৈরি করেন অন্যের কল্যাণে। সহকর্মীদের সাথে নিয়ে ঝাপিয়ে পড়েন কলেজের দরিদ্র ছাত্রীদের সাহায্যার্থে। কখনো কারো বাড়িতে খাবারের প্যাকেট পাঠাচ্ছেন, আবার কাউকে বিকাশে টাকা পাঠিয়ে সাহায্য করছেন। এভাবেই এক সময় নিজেও করোনা আক্রান্ত হয়ে মুত্যুর দুয়ারে চলে যান। আর তখনই বুঝা যায় উনার প্রিয় সহকারীরা উনাকে কতোটা ভালবাসেন। প্রিয় ছাত্রীরা উনার জন্য কেউ রোজা রেখেছেন, কেউ মন্দিরে পূজা দিয়েছেন। সবার ভালবাসায় মহান স্রষ্টা উনাকে সুস্থ করে আবার মহিলা কলেজের প্রাণ ফিরিয়ে দেন। করোনা পরবর্তী সময়েও শুধু ছাত্রীদের পড়ালেখার প্রতি গুরুত্ব দেন নি। ছাত্রীদের জন্য সাংস্কৃতিক সংগঠন মেঘমল্লার, বির্তক পরিষদ গঠন করে পড়ালেখার পাশাপাশি সহপাঠক্রমিক শিক্ষার প্রতিও জোর দেন। কলেজ ছাত্রীদের একই ইউনিফর্মে আনার জন্য কিছু ছাত্রীকে স্বাবলম্বী করার জন্য এবং গরীব মেধাবী শিক্ষার্থীদের সাহায্য করার জন্য তিনি ‘ব্যতিক্রম’ নামে অভিনব এক ছাত্রী কল্যাণ সংস্থার সৃষ্টি করেন। প্রিয় অধ্যক্ষের কাছে প্রাণের ছাত্রীদের আবদারের ও যেন শেষ নেই। তারা কলেজের ক্যান্টিন খোলার দাবি জানালে ব্যতিক্রমী এই অধ্যক্ষ “থার্টি মিনিটস ক্যাফে” নামক একটি ক্যাফে স্থাপন করে ছাত্রীদের স্বল্পমূল্যে হোম মেইড খারবের ব্যবস্থা করেন। এমন উদ্যমী, কাজ পাগল শিক্ষার্থী বান্ধব অধ্যক্ষ আজ তার প্রিয় মহিলা কলেজ ছেড়ে যাচ্ছেন আরো বৃহত্তর কর্ম পরিবেশে। সবার প্রিয় অধ্যক্ষ মহোদয় আজ মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড কুমিল্লা’র চেয়ারম্যান পদে আসীন হতে যাচ্ছেন। সবাই স্যারের এই পদায়নে স্রষ্টার কাছে কৃতজ্ঞ। কিন্তু কুমিল্লা সরকারি মহিলা কলেজ থেকে এক মহানায়কের প্রস্থান হচ্ছে। ছাত্রী সহকর্মীরা বুকে পাথর চাপা দিয়ে তাকে বিদায় জানাতেই হচ্ছে। সান্ত্বনা খুঁজছে জীবনান্দের মতো করে, ”প্রেম ধীরে মুছে যায়, নক্ষত্রেরও একদিন ঝরে যেতে হয়,”…
আরেক সহকর্মী দর্শন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক বাসোনা বেগম “একজন স্বপ্নবাজ মানুষের গল্প” শিরোনামে তিনি লিখেছেন– গতকাল বৃহস্পতিবার (২৯ সেপ্টেম্বর) ছিল কুমিল্লা সরকারি মহিলা কলেজের সদ্য বিদায়ী অধ্যক্ষ, বর্তমানে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ড কুমিল্লা’র মাননীয় চেয়ারম্যান প্রফেসর মো. জামাল নাছের স্যারের কুমিল্লা সরকারি মহিলা কলেজ কর্তৃক বিদায় সংবর্ধনা অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানটি বিকেল ৪.৩০ শুরু হয়ে রাত ১২.৩০ পর্যন্ত চলে। এত দীর্ঘ সময়ে ও আমরা কেউ ক্লান্ত হয়নি। মনে হচ্ছিল সারারাত কেটে গেলে ও আমরা ক্লান্ত হবোনা মন্ত্রমুগ্ধের মতো আমরা প্রত্যেকেই প্রত্যকের স্যারের সাথে কাটানো আবেগঘন স্মৃতিচারন শুনছিলাম। কেউ একজন স্মৃতিচারন করতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ছেন তো তার সাথে আমরা সবাই কাঁদছি। প্রায় সবাই স্মৃতিচারন করতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েছেন। একজন মানুষের এর চেয়ে পাওয়া আর কী হতে পারে! প্রফেসর মো. জামাল নাছের এমন একজন ব্যক্তিত্ব যার তুলনা শুধু তিনি নিজে। কুমিল্লা সরকারি মহিলা কলেজের প্রতিটি ধূলিকণার সাথে তার আত্মার সম্পর্ক। আজকের এই আধুনিক সাজে সজ্জিত কলেজটি তারই তিলে তিলে গড়া স্বপ্নের ফসল। কোন বিদায় কী সে সম্পর্ক ছিন্ন করতে পারে? তিনি স্বপ্নবাজ রাজকুমার। নিজে স্বপ্ন দেখেন,অন্যকে ও দেখান। তার অসংখ্য গুণ।তার মধ্যে কয়েকটি বিষয় আমার মনে ভীষণ দাগ কেটেছে।তার নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা অসাধারণ। কী চমৎকারভাবে গত সারে চার বছর আমাদেরকে সাথে নিয়ে কাজ করেছেন, কাজ করিয়েছেন। আরেকটা বিষয়- তিনি শিশুদের অত্যন্ত ভালবাসেন। আমাদের সহকর্মীদের বাচ্চাদের সাথে স্যারের ছিল খুব সহজ সম্পর্ক। আমি যখন এই কলেজে বদলি হয়ে আসি তখন আমার ছোট মেয়ে সুধার পাঁচমাস। বলতে গেলে কলেজেই বড় হয়েছে।স্যার আমার মেয়েকে খুব আদর করতেন। স্যার তখন ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ছিলেন। সুধাকে খুঁজে পাচ্ছি না তো গিয়ে দেখতাম স্যারের চেয়ারে বসে স্যারের সাথে গল্প করছে। স্যার পাশে আরেকটি চেয়ারে বসা।এমনি ভালবাসেন শিশুদেরকে। স্যারের অর্ডার হওয়ার পর যখন বাসায় আলোচনা করছিলাম তখন সুধা বলল, ‘প্রিন্সিপাল আংকেলকে ছাড়া কলেজ কিভাবে চলবে?’ ওর শিশুমনের প্রশ্ন আমাদের সবার। আসলে স্যারকে ছাড়া কুমিল্লা সরকারি মহিলা কলেজের কথা ভাবা যায়না। আমরা স্যারের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে বদ্ধ পরিকর। আরেকটি বিষয় আমাকে অনেক বেশি মুগ্ধ করেছে- সেটি হলো শিক্ষার্থীদের প্রতি স্যারের অকৃত্রিম, অকৃপণ ভালবাসা। শিক্ষার্থীদের ভালর জন্য স্যার সব কিছু করতেন। নিজের পকেটের টাকা দিয়ে শিক্ষার্থীদের ফরম পূরন, বই কিনে দেওয়া,ড্রেস তৈরি করে দেওয়াসহ অনেক কিছু করতেন। এত ঔদার্যতা দেখানো শুধু স্যারের পক্ষেই সম্ভব। আমি আমার বিভাগের দরিদ্র শিক্ষার্থীদের নিয়ে যখনই স্যারের কাছে গিয়েছি স্যার হতাশ করেননি। আমার প্রাক্তন বিভাগীয় প্রধান প্রফেসর আজহারুল হক স্যার বলতেন, ‘আপনি যান, স্যারের অভিধানে ‘না’ শব্দটি নেই।’ সত্যিই তাই।একবার দরিদ্র তহবিল থেকে টাকা দেওয়ার সময়সীমা শেষ। এমন সময় এক শিক্ষার্থী এসে কাঁদছে। মেয়েটির কান্নাকাটি সহ্য না করতে পেরে মেয়েটিকে নিয়ে স্যারের কাছে গেলাম। স্যার ফরম পূরণের পুরো টাকাটাই মওকুফ করে দিলেন। মেয়েটির মুখে হাসি ফুটে উঠল এরকম অসংখ্য শিক্ষার্থীর মুখে স্যার হাসি ফুটিয়েছেন।
আগেই বলেছি স্যার স্বপ্নবাজ মানুুষ। স্যার পুরো দেশকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেন। স্যারের স্বপ্নই স্যারকে আজ এই জায়গায় নিয়ে গেছেন। আরো মর্যাদার জায়গায় স্যার যাবেন এই প্রত্যাশা আমাদের।
আপনার মতামত লিখুন :