রুবেল মজুমদার : কুমিল্লার জেলার ঐতিহ্য ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের প্রতীক লালমাই পাহাড়। কুমিল্লা শহর থেকে ৮ কিলোমিটার পশ্চিমে উত্তর ও দক্ষিণে দীর্ঘ প্রায় ১৫ কিলোমিটার জুড়ে লালমাই পাহাড়ের প্রাচীন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন আধুনিক সভ্যতার ছোঁয়ায় গড়ে উঠা এক সম্ভাবনাময় পর্যটন নগরী এটি। এখানের ছোট বড় ১০টি পাহাড় ঘিরে ৪০ পয়েন্টে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে মাটিদস্যু চক্র। কোনোভাবেই থামানো যাচ্ছে না তাদের। এদের হাতে লালমাই পাহাড় এখন ক্ষতবিক্ষত।
কিছু অসাধু স্থানীয় রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী নিজস্ব ফায়দা লুটতে পাহাড়ের মাটি কেটে বিক্রি অথবা প্রতিষ্ঠান কিংবা ব্যক্তিগত রিসোর্ট তৈরি করছেন। এ নিয়ে স্থানীয় লোকজনের মাঝে ক্ষোভ থাকলেও প্রভাবশালীদের ভয়ে কেউ মুখ খুলতে পারছেন না। প্রভাবশালী মহলটি প্রকাশ্যে দিবালোকে কেটে নিয়ে যাচ্ছে পাহাড়ের মাটি।
এছাড়া এ পাহাড়ে থাকা বেশকিছু প্রাচীন ঐতিহাসিক নিদর্শন এখন ক্ষতির মুখে। এরপরও থেমে থাকেনি পাহাড় কেটে নানা স্থাপনা নির্মাণের। ফলে দিন দিন পাহাড়ের শ্রেণি পরিবর্তন হতে থাকে।
জেলা প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, এই পাহাড়ের দৈর্ঘ্য ৮ কিলোমিটার, অংশভেদে গড় প্রস্থ প্রায় ৪ দশমিক ৮ কিলোমিটার এবং সর্বোচ্চ উচ্চতা ৪৬ মিটার। পাহাড়কে দ্বিখণ্ডিত করে যাওয়া ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের দক্ষিণাংশ লালমাই ও উত্তরাংশ ময়নামতি পাহাড় নামে পরিচিত। উঁচু-নিচু দুইটি পাহাড়ে জেলার আদর্শ সদর, সদর দক্ষিণ, লালমাই, বরুড়া ও বুড়িচং উপজেলার অংশবিশেষ রয়েছে। তবে স্থানীয়দের অভিযোগ, অর্থমন্ত্রী লোটাস কামালের ভাতিজা পরিচয়দানকারী মোস্তফা উদ্দিন লিটন নেতৃত্বে মূলত লালমাই পাহাড়ের মাটি কাটা আবার শুরু হয়েছে । লিটনের জেলায় একাধিক ইটভাটা রয়েছে। মূলত সদর দক্ষিণ ও লালমাই উপজেলার তার নামে পাহাড় স্কেভেটর দিয়ে অবৈধভাবে কেটে বিভিন্ন জায়গায় মাটি বিক্রি হচ্ছে। তবে এই পাহাড়ের মাটির একাংশ যায় তার এসব ইটভাটায়। প্রকাশ্যে পাহাড় কেটে সাবাড় করে ফেললেও প্রশাসন এ ব্যাপারে নীরব ভূমিকা পালন করছেন।
অর্থমন্ত্রীর লোটাস কামালের ভাতিজা পরিচয়দানকারী অভিযুক্ত মোস্তফা উদ্দিন লিটন বলেন, আমি কোনো মাটি কাটি না, আমার নামে মিথ্যা কথা বলছেন যারা মাটি কাটেন তারা ।
লাইমাই পাহাড়ের অনেক স্থানে মাটি কেটে করা হয়েছে সমতল। কোথাও কোথাও পাহাড়ের বুক চিরে সমতল করা জায়গায় স্থানীয়ভাবে সীমানা প্রাচীর তৈরি করা হচ্ছে। আবার পাহাড়ের মাটি কাটার কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে অধ্যাধুনিক ভেকু মেশিন। যার মাধ্যমে দ্রুততার সঙ্গে পাহাড়ের মাটিগুলোকে কেটে ফেলা হচ্ছে। বিগত সময়ে রেলপথ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থানীয় ক্যাম্পাস, চার লেনের মহাসড়কসহ অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন সড়ক উন্নয়নের প্রয়োজনে কাটা হয়েছে পাহাড়। উত্তর লক্ষ্মীপুরসহ বিভিন্ন স্থানে মাটি কাটার ফলে অনেক এলাকা এখন অনেকটা সমতল ভূমিতে পরিণত হয়েছে। মাটিকাটা সিন্ডিকেট এখন চারপাশে টিনের বেড়া দিয়ে নতুন নতুন কৌশলে পাহাড় কাটছে। মাটি কাটার পুরোনো ও নতুন ক্ষতচিহ্ন ছড়িয়ে রয়েছে পাহাড়জুড়ে।
শনিবার (২৯ জানুয়ারি ) দিনভর সরেজমিন ঘুরে যায়, লালমাই-ময়নামতি পাহাড়ের লীলামুড়া, বড় ধর্মপুর, চন্ডিপুর, রতনপুর, হরষপুর, রাজারখল, সালমানপুর, এছাড়া কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন এলাকা, সানন্দা, জামমুড়া, রাঙ্গামুড়া, ষাইট কলোনী, খলা,ধনমুড়া বিশাল পাহাড়ের অংশ থেকে বছরের পর বছর ধরে অব্যাহত মাটি কাটায় পাহাড়ের বহুস্থান সমতল ভূমিতে পরিণত হয়েছে।
এছাড়া লালমাই পাহাড়ের সদর দক্ষিণ উপজেলার বড় ধর্মপুর লেকল্যান্ডের এলাকার অন্তত শতাধিক বাসিন্দা জানান, কয়েকদিন পর পর টিনের বেড়া দিয়ে দিনে-রাতে উঁচু একটি পাহাড় কাটা হচ্ছে। বিশেষ করে পাহাড়ি এলাকা উঁচু পাহাড়ের রাস্তার পাশের অংশ কৌশলে ঠিক রেখে পেছনের অংশের মাটি কেটে সমতল করা হয়েছে।
আবার কোথায় কোথায় পাহাড় কেটে গভীর পুকুর বানিয়ে অনেকেই করছেন মৎস্য চাষ করছে। এছাড়াও প্রতিদিন পাহাড় কেটে তৈরি হচ্ছে বাসাবাড়ি বা মোটেল, বিনোদন কেন্দ্রসহ নানা প্রতিষ্ঠান। অব্যাহতভাবে পাহাড় কাটায় প্রতিদিনই কমছে পাহাড়ের আকার। এতে নিশ্চিহ্ন হচ্ছে পাহাড়, ধ্বংস হচ্ছে পাহাড়ে থাকা মূল্যবান অনেক ফলদ, বনজ বৃক্ষ আর হারিয়ে যাচ্ছে পশু-পাখি। সরকারিভাবে পাহাড় কাটা নিষিদ্ধ হলেও গত প্রায় ৩৭ বছর ধরে বিরামহীনভাবে চলছে কুমিল্লার ঐতিহাসিক লালমাই-ময়নামতি পাহাড় কাটা। পাহাড়ের বিভিন্ন স্থানে আলাপকালে নাম প্রকাশ না করার শর্তে অনেকেই জানান, যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে তখন সেই দলের লোকেরা পাহাড় কাটে। মাঝে পুলিশ-সংবাদকর্মীসহ অন্যদের ম্যানেজে বাড়তি কিছু টাকা খরচ করতে হচ্ছে। তবে মাঝে মাঝে প্রশাসন থানা-পুলিশ নিয়ে লোকদেখানো অভিযান চালায়। তবে অজ্ঞাত কারণে এর বাইরে যারা মাটি বা পাহাড় কাটায় নেতৃত্ব দিচ্ছেন তাদের বিরুদ্ধে কোনো মামলা হয়নি।
অথচ পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় পাহাড়-টিলার গুরুত্ব অতুলনীয়। ১৯৯৫ সালে পরিবেশ সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী দেশে পাহাড় বা টিলা কাটা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। পরে ২০১০ সালে আইনটি সংশোধনের মাধ্যমে আরও কঠোর করা হয়। দেখা যায়, এই আইন শুধু কেবল ফাইল-খাতায়ই সীমাবদ্ধ, নেই তার কোনো বাস্তব প্রতিফলন। তাদেরই উদাসীনতার ফলে এমন বেআইনি কাজ দিন দিন বেড়েই চলছে।
কুমিল্লা পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা মোসাব্বের হোসেন মুহাম্মাদ রাজীব বলেন, এ মৌসুমে ইটভাটাসহ সরকারি বিভিন্ন প্রকল্প নিয়ম না মেনে লাল মাটি কাটছেন। আমরা তালিকা তৈরি করেছি,স্থানীয় কয়েকজনের রাজনীতিকবিদ নাম আসছে, আপনারা তো জানেন বিগত সময় পরিবেশ উপ-পরিচালক লালমাই পাহাড় নিয়ে কাজ করতে গিয়ে বিভ্রান্তকর অবস্থায় পড়তে হয়েছিলো। তবু আমি আমার দায়িত্ব পালনে আপনাদের সহযোগিতা কামনা করছি।
কুমিল্লা জেলা প্রশাসক মোহাম্মাদ শামীম আলম বলেন, প্রাকৃতিক সম্পদ পাহাড় রক্ষার জন্য প্রশাসনের পাশাপাশি সব মহলকেই সচেতন হতে হবে। পাহাড় কাটার তথ্য যখনই আসে তখনই আমরা আইনগত পদক্ষেপ নিচ্ছি।
তবে প্রশাসন নিরব কেনো এমন প্রশ্নে মোহাম্মাদ শামীম আলম বলেন, আমি এখনি খোঁজখবর নিচ্ছি। প্রয়োজনে টিম পাঠাবো।
আপনার মতামত লিখুন :