• ঢাকা
  • বুধবার, ১৮ই ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৩রা পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ৪ জুলাই, ২০২২
সর্বশেষ আপডেট : ৪ জুলাই, ২০২২
Designed by Nagorikit.com

পরিকল্পিত পর্যটন শিল্প ও পদ্মাসেতু

কুমিল্লা জার্নাল
[sharethis-inline-buttons]

পদ্মাসেতুকে নিয়ে আজ প্রতিটি দেশবাসীর গর্ব হচ্ছে। পদ্মাসেতু নির্মাণে যার অবদান সবচেয়ে বেশি, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ব্যক্তি, গোষ্ঠী ও মহলের সকল বাধাকে উপেক্ষা করে, যার অদুরদর্শী নের্তৃত্বে এই স্বপ্নজয়ের পদ্মাসেতুর সফল বাস্তবায়ন আজ দৃশ্যমান সেই গণতন্ত্রের মানসকন্যা, মাদার অব হিউম্যনিটি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে জানাই আন্তরিক শুভেচ্ছা ও ধন্যবাদ। শেখ হাসিনার বাংলাদেশ আজ বিশ্বের কাছে উন্নয়নের রোল মডেল। পদ্মাসেতুর মত আরো ডজনখানেক মেগা-প্রজেক্ট এ বছরই বাস্তবায়নের অপেক্ষায় আছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নের্তৃত্বের ভীত কতটা শক্ত, তা এসব মেগা-প্রজেক্ট বাস্তবায়নের চিত্র দেখলেই বুঝা যায়। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৭ই মার্চের ভাষণে সেই উত্তাল জনসভায় বলেছিলেন, “আমাদের কেউ দাবায়ে রাখতে পারবানা।” আসলেই তো, এ কথা আজ অক্ষরে অক্ষরে ফলে যাচ্ছে। পদ্মাসেতুর একটি সফল অর্জন এটাই প্রমাণ করে বাঙালীকে কেউ দাবায়ে রাখতে পারবেনা। বিশ্বব্যাংকের চোখ রাঙানি, দেশি-বিদেশি সকল ষড়যন্ত্র উপেক্ষা করে পদ্মার বুকে দন্ডায়মান অবাক বিস্ময়, স্বপ্নজয়ের উপাখ্যান, আমাদের পদ্মাসেতু।

স্বাধীন দেশে চোখে পড়ার মত বড় কোন অর্জন যদি বাঙালী জাতি দেখে থাকে তা হল পদ্মা সেতু। আমাদের স্বপ্নের সেতু। কিন্তু আমি বলব পদ্মাসেতু হল স্বপ্নজয়ের সেতু। দূর্গম পথের সকল কঠিন বাধা পাড়ি দিয়ে ধুসর বর্ণের পদ্মাসেতু আজ দাঁড়িয়ে আছে আমাদের কোটি বাঙালীর গর্ব হয়ে। দেশের ২১ জেলার ৩ কোটি মানুষের ভাগ্যোন্নয়নের গল্প বলবে পদ্মাসেতু। পদ্মাসেতু কি শুধু পারাপারের সেতুবন্ধনের নিমিত্তে তৈরী? আর কি কিছু চোখে পড়ছেনা? বাংলাদেশের জিডিপিতে ১৪% ভূমিকা রাখে যে খাতটি সেই খাতের অপার সম্ভাবনার সোপান হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আমাদের পদ্মাসেতু। এ সেতু পর্যটন শিল্পের বিকাশে এক শক্ত অবস্থান রাখবে বলে আমি মনে করি। অনেকে বলছেন পদ্মাপাড়ে গড়ে উঠবে হোটেল, মোটেল, রিসোর্ট, তাত পল্লী, যাদুঘর সহ আরও কত কি। কিন্তু পর্যটন শিল্পকে সঠিক ও পরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলার উপরই ভিত্তি করে এ শিল্পের সফলতা। ওখানে হতে পারে আন্তর্জাতিক মানের সব পাচতারকা হোটেল সহ বিনোদনকেন্দ্র। বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক মানের বিনোদন কেন্দ্র হিসেবে আছে কনকর্ড গ্রুপের “ফ্যান্টাসি কিংডম” ও চট্রগ্রামে অবস্থিত “ফয়ে’স লেক”। দেশের দক্ষিণাঞ্চলের পর্যটকদের জন্যও আমরা সমমানের বিনোদনকেন্দ্র স্থাপন করতে পারি যেখানে একজন পর্যটক পাবে থাকা, খাওয়া সহ বিনোদনের সকল সুবিধা।
স্বাধীনতা পরবর্তী নদীমাতৃক এই বাংলাদেশ নিয়ে বিশ্বের সব জাতিই ছিল শংকিত। ভোখা, নাংগা এই দেশের মানূষের অর্থনীতির সূচক ছিল শূন্যের কোঠায়। বন্যা, খড়া আর জলোচ্ছাসের মত প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণেই পরিচিত ছিল বাংলাদেশ বিশ্বের কাছে। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পরে আমরা আজ অর্থনীতিতে এশিয়ান টাইগার তথা ইমার্জিং টাইগার। বাঘের মত গর্জে উঠছে আমাদের অর্থনীতি পৃথিবীর সকল দেশকে টেক্কা দিয়ে। পর্যটন শিল্পের অপার সম্ভাবনার এই দেশে, আমরা এখনো এই খাতটিতে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মত তেমন সুবিধা করতে পারছিনা। অথচ টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া পর্যন্ত একজন পরিব্রাজকের কাছে মনকাড়া দর্শনীয় স্থানের অভাব নেই। আমাদের পদ্মাসেতু পর্যটন শিল্প বিকাশের সম্ভাবনাকে আরও বাড়িয়ে দিল বহুগুণ। পর্যটন উন্নয়নে সবচেয়ে বড় বাধা বা অন্তরায় যোগাযোগ ব্যবস্থার ও নিরাপত্তাহীনতা। পদ্মাসেতুর কারণে যেহেতু যোগাযোগ ব্যবস্থাপনায় দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলার সাথে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে তাই এই অঞ্চলে পর্যটন শিল্পের উন্নয়ন অনিবার্য। তাই পদ্মাসেতুর কারণে দেশের পর্যটন শিল্পের গতিধারা বদলে যেতে পারে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ তাদের জাতীয় অর্থনীতিকে শক্তিশালী ও সুসংগঠিত করতে পর্যটন শিল্পকে তাদের ব্যবসায়ীক হাতিয়ার হিসেবে বেছে নিয়েছে। অথচ পর্যটন শিল্পে বাংলাদেশের অপার সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও আমরা এই শিল্পের বিকাশকে অগ্রাধিকার দিচ্ছিনা। আজ পদ্মাসেতু আমাদের চোখ খুলে দিয়েছে। আমরা আজ ভাবতেই পারি, বাংলাদেশ হবে এশিয়ার অন্যতম টুরিষ্ট প্যারাডাইজ।

আমাদের দেশের অধিকাংশ পর্যটন শিল্পই প্রকৃতি নির্ভর। সমুদ্র, পাহাড় আর বনাঞ্চলে ভরপূর পর্যটনকেন্দ্রগুলো ঠিক যেভাবে পরিকল্পিতভাবে পর্যটকবান্ধব হিসেবে গড়ে তুলার দরকার ছিল, সেই পরিকল্পনা মাফিক হয়নি বলে সরকার রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এ খাত থেকে। বাংলাদেশের কক্সবাজার, সিলেট আর রাঙামাটিকে পর্যটকেরা যেভাবে ডেসটিনেশন গোল হিসাবে মনে করে, সেভাবে আমাদের দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন স্থানকে আমরা একমাত্র যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির অভাবে দেশী-বিদেশী পর্যটকদের কাছে আকৃষ্ট করতে পারিনি। ভারতের যেমন আছে পর্যটন সিটি “গোয়া”, আমরাও পারি অপার সৌন্দর্যের লীলাভূমি সাগরকন্যা পটুয়াখালীকে দক্ষিণের পর্যটন শহর বানাতে। এক পর্যটন খাত থেকেই বাংলাদেশের দক্ষিণের মানূষের জীবন ও জীবিকার ভাগ্য বদল ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি আসতে পারে পদ্মাসেতুর বদৌলতে। এজন্য দরকার সরকারের এ শিল্পের প্রতি সুদৃষ্টি ও দুরদর্শি মহা-পরিকল্পনা। তাহলে দেশের মোট জিডিপিতে পর্যটন শিল্পের প্রবৃদ্ধি অর্জন ৩০ শতাংশে উন্নিত হতে হয়তো সময়ের ব্যপার মাত্র। দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার সর্বোতকৃষ্ট সংযোজন পদ্মাসেতু। ভাগ্য বদলে দেয়া এই সেতু দেশের পর্যটন শিল্পের জন্য আশীর্বাদ স্বরুপ। বদলে যাওয়া বাংলাদেশের চিত্র যেন পদ্মাসেতু দিয়েই শুরু হল। এ বদলে যাওয়া বাংলাদেশকে দেখতে যারা আসবেন তারাই হলেন বাংলাদেশে ঘুরতে আসা পর্যটক। তারাই আমার দেশে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের বাহক৷ যে দেশে সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ফরেষ্টের মত ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ আছে, যে দেশে নকশীকাথা আছে, যেদেশে পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত আছে, যেদেশে স্বপ্নের পদ্মাসেতু আছে সেদেশে পর্যটন বিকাশ অবধারিত। দরকার ছিল যোগাযোগ ব্যবস্থাপনার প্রভূত উন্নতি। তা পদ্মাসেতুর মাধ্যমেই সাধিত হয়েছে।

পরিবেশ, প্রতিবেশ ও পারিপার্শ্বিক অবস্থান, এই তিন “প” এর সমন্বয়ে স্থাপনা নির্ভর পর্যটন শিল্প গড়ে উঠে। প্যারিসের আইফেল টাওয়ার কিংবা লন্ডনের টেমস নদীর স্থাপনা দেখতে যাওয়া একজন পর্যটকের মুল ডেস্টিনেশন থাকে। আমাদের পদ্মাসেতুকেও সেই রকম একটা গ্লোবাল ব্র‍্যান্ডিংয়ের মাধ্যমে বিশ্ববাসীর কাছে পরিচিত করতে হবে। এটি যে একটি শ্রেষ্ঠ “ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ান্ডার” সেটি বিশ্ববাসীকে জানান দিতে হবে। শোনা যাচ্ছে, পদ্মাসেতু ট্রান্স এশিয়ান এক্সপ্রেস হাইওয়ে রুটের সাথে যুক্ত হতে যাচ্ছে। এটি তখন ভারত, চীন, ইরান হয়ে ইউরোপে গন্তব্য হবে। ট্রেনে করে ইউরোপের যাত্রীরা নামবে শরীয়তপুরের জাজিরায় পদ্মাসেতু দেখতে। তাহলে বৈশ্বিক পর্যটন শিল্পের এক বিশাল গেটওয়ে হতে যাচ্ছে পদ্মাসেতু।

বিপুল পরিমাণ দেশী-বিদেশী বিনিয়োগের হাতছানি আমরা দেখতে পাচ্ছি পদ্মাসেতুর কারণে। পদ্মার বুকে পদ্মাসেতু দাঁড় করানো যেমন ছিল কোটি বাঙালীর স্বপ্ন, তেমনি পদ্মাসেতু চালু হওয়ার পর দেশের দক্ষিণাঞ্চলের পর্যটন বিকাশের স্বপ্নও আমাদের তাড়া করছে।
ভারীশিল্প, প্রবাসীদের রেমিটেন্স বা পোষাকশিল্পের সাথে এক কাতারে পর্যটন শিল্পকে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি অর্জনের সহায়ক শক্তি হিসাবে দেখতে চাইলে এখনই এর একটি মেগাপ্লান দরকার। ভৌতিক ও অবকাঠামোগত উন্নয়নের পাশাপাশি এই খাতে দক্ষ জনবল তৈরীও একটি কি-ফ্যাক্টর বলে আমি মনে করি। বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড এর মধ্যে দেশের এগারশ স্পট নিয়ে মাষ্টারপ্ল্যান করছে। কিছু গুরুত্বপূর্ণ জায়গার আর্কিটেকচারাল, ষ্ট্র্বাকচারাল ও ইনভেস্টমেন্ট প্ল্যানও রয়েছে। এর মধ্যে বরিশাল ও খুলনার পর্যটন স্পটগুলো অগ্রাধিকার পাবে। যদি এর সঠিক বাস্তবায়ন ঘটে তাহলে পর্যটন শিল্পের কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বিশেষ সুপ্রভাব পড়বে বলে আমি মনে করি। ফ্রান্সের আইফেল টাওয়ার বা দুবাইয়ের বুর্জ আল খলিফাকে পর্যটকরা দেখতে যেভাবে আকৃষ্ট হয়, ঠিক সেভাবে পদ্মাসেতুকেও আকৃষ্ট করানোর জন্য এর একটি সঠিক ও যূগপোযোগী ব্র‍্যান্ডিং বিশ্বদরবারে উপস্থাপন করতে হবে।

দ্বীপরাষ্ট্র মালদ্বীপ শুধু পর্যটন সুবিধা বাড়িয়ে যেমন তার পর্যটনশিল্পকে দেশের একমাত্র প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধির খাত হিসেবে এক ঈর্ষণীয় অবস্থানে আছে ঠিক তেমনি আমাদেরও সেই অবস্থানে আসার সময় এসেছে। দরকার সঠিক সুপরিকল্পনা, বৃহদাকারে পর্যটন সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায়। বাংলাদেশের ট্যুরিস্ট স্পটগুলোকে আকর্ষণীয় ও নয়নাভিরাম করে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিকট জোর দাবি জানাচ্ছি যাতে বৈশ্বিক ও আভ্যন্তরীণ পর্যটক আকর্ষণ বৃদ্ধি পায়।

একমাত্র পর্যটনশিল্পে কোন প্রাকৃতিক বিপর্যয় বা বড় কোন বৈশ্বিক মন্দা দেখা না দিলে এর মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন তেজীহারে বাড়তে থাকে লাগামহীন ঘোড়ার মত।
পর্যটন শিল্পের বিকাশ ভবিষ্যত বাংলাদেশকে পদ্মাসেতুর মতই বিশ্ববাসীর কাছে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাবে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস। এ সেতু দক্ষিণাঞ্চলের পর্যটন শিল্পের ভীত গড়ে তুলার ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।

পরিশেষে, ধুসর বর্ণের স্বপ্নের পদ্মাসেতু আমাদের অর্থনীতিতে চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করবে। এই স্বপ্নের সেতু আগামী দিনের বাংলাদেশকে এক গর্বিত বাংলাদেশ হিসেবে বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরবে। স্বপ্নজয়ের এই সেতু বাংলাদেশের পর্যটন শিল্প বিকাশের স্বপ্ন বাস্তবায়নে বিশেষভাবে কার্যকরী। দক্ষিণাঞ্চল তথা বাংলাদেশের উদিয়মান বৈশ্বিক পর্যটন শিল্পের বিকাশে অনবদ্য ভূমিকা রাখবে আশা করি।

লেখকঃ মীর মাহফুজুর রহমান,

মিডিয়া কো-অর্ডিনেটর,
বাংলাদেশ এসোসিয়েশন অব এমিউজমেন্ট পার্ক এন্ড এটরাকশন্স( বাপা)।

[sharethis-inline-buttons]

আরও পড়ুন

  • অন্যান্য এর আরও খবর