সামাজিক যোগযোগমাধ্যমে ভারত ও দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সম্পর্কে মালদ্বীপের মন্ত্রীদের অসম্মানজনক মন্তব্য ঘিরে বিতর্কের ফলে ইতোমধ্যে অস্থির ভারত-মালদ্বীপ সম্পর্ক নতুন চাপের মধ্যে পড়েছে।
যদিও নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মোহামেদ মুইজ্জুর নেতৃত্বাধীন মালদ্বীপ সরকার ওই আক্রমণাত্মক মন্তব্যগুলোর দায় নিতে রাজি নয় বলে ইতোমধ্যে জানিয়েছে। মালদ্বীপের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিবৃতি দিয়ে বলেছে, মন্তব্যগুলো ‘সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের একান্ত ব্যক্তিগত এবং মালদ্বীপ সরকারের মতামতকে প্রতিনিধিত্ব করে না।’ এ কারণে তিন উপমন্ত্রীকে সাময়িক বরখাস্তও করা হয়েছে। ভারত কিন্তু এর কোনোটাতেই সন্তুষ্ট হয়নি। বরখাস্ত করার পরদিন ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মন্ত্রীদের মন্তব্য বিষয়ে তাদের উদ্বেগ জানাতে নয়াদিল্লিতে মালদ্বীপের রাষ্ট্রদূতকে ডেকে পাঠায়। অন্যদিকে মালদ্বীপের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও রাজধানী মালেতে ভারতীয় হাইকমিশনারকে তলব করে। অর্থাৎ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কথার যুদ্ধ ইতোমধ্যে দুই দেশের কূটনৈতিক দ্বন্দ্বে পরিণত হয়েছে।
এ সবকিছুর সূচনা ৪ জানুয়ারি, যখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী দেশটির লাক্ষা দ্বীপপুঞ্জ পরিদর্শনকালে দ্বীপগুলোর অত্যাশ্চর্য সৌন্দর্যের প্রশংসা করে তাঁর এক্স হ্যান্ডলে (সাবেক টুইটার) একাধিক পোস্ট করেন। সেখানে তিনি লেখেন, ‘যারা দুঃসাহসকে আলিঙ্গন করতে চায় তাদের জন্য লাক্ষা দ্বীপ আপনার তালিকায় থাকতেই হবে।’
আরব সাগরের বুকে ৩৬টি দ্বীপ-সংবলিত লাক্ষা দ্বীপপুঞ্জ দক্ষিণ ভারতের কেরালা রাজ্যের উপকূলে অবস্থিত। এর পশ্চিমে রয়েছে মালদ্বীপ, ১ হাজার ১৯২টি দ্বীপের একটি সমষ্টি। লাক্ষা দ্বীপ ও মালদ্বীপ উভয়ই পর্যটকদের পছন্দ, তবে টাকাওয়ালা পর্যটকদের কাছে মালদ্বীপই বেশি পছন্দের।
মোদি তাঁর পোস্টে মালদ্বীপের কোনো উল্লেখ করেননি। যা হোক, লাক্ষা দ্বীপ নিয়ে তাঁর পোস্টের কয়েক ঘণ্টার মধ্যে মোদির কিছু সমর্থক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দাবি করেন, তাঁর এ সফর পর্যটকদের কাছে দ্বীপমালাটির আকর্ষণ বাড়াবে। এমনকি তারা লাক্ষা দ্বীপকে মালদ্বীপের বিকল্প পর্যটনস্থল হিসেবেও দাবি করেন। কেউ কেউ মালদ্বীপের বদনামও করতে থাকেন। যেমন ‘মিস্টার সিনহা’ নামে একটি অ্যাকাউন্টে, যিনি এক্সে নিজেকে একজন ‘ভারতীয় রাজনৈতিক ভাষ্যকার’, ‘হিন্দু অধিকার কর্মী’ এবং ‘গর্বিত ভারতীয় (ভারতীয়)’ হিসেবে বর্ণনা করেন, মোদির ‘চমৎকার পদক্ষেপ’-এর প্রশংসা করে বলা হয়, এর ফলে লাক্ষা দ্বীপে পর্যটন উৎসাহিত হবে। তিনি লেখেন, ‘এটি মালদ্বীপে চীনের নতুন পুতুল সরকারের জন্য একটি বড় ধাক্কা।’ পোস্টটি ৩২ লাখ বার দেখা হয়েছে।
মুইজ্জু মালদ্বীপের প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেওয়ার পর বেশ কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, যা ভারতে এই ধারণা তৈরি করেছে– তিনি চীনপন্থি।
মুহূর্তের মধ্যে ভারত ও মালদ্বীপের নাগরিকদের পোস্টের ঢেউ, যাদের অনেকেই মোদি বা মুইজ্জু সরকারের সমর্থক, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে এবং খুব অল্প সময়ের মধ্যে মালদ্বীপের যুব ক্ষমতায়ন, তথ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের তিনজন উপমন্ত্রী– মরিয়ম শিউনা, মালশা শরিফ ও মাহজুম মজিদ এ কাদা ছোড়াছুড়িতে জড়িয়ে পড়েন।
এক্সে ইতোমধ্যে মুছে ফেলা এক পোস্টে শিউনা মোদিকে ‘লাইফ জ্যাকেট পরা ডুবুরি’ বলে উপহাস করেন এবং তাঁকে ‘ক্লাউন’, ‘সন্ত্রাসী’ এবং ‘ইসরায়েলের পুতুল’ হিসেবেও বর্ণনা করেন। একই পোস্টে তিনি ভারতকে গোবরের সঙ্গে তুলনা করেন। এসবই ভারতকে ক্ষেপিয়ে তোলে।
এদিকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয় যখন ভারত ও মালদ্বীপের লোকেরা একে অন্যকে অপমান করতে থাকে। এটি সেখানেই থেমে থাকেনি। ভারতীয় চলচ্চিত্র তারকা, ক্রিকেটার এবং অন্য সাধারণ মানুষ ভারতীয়দের প্রতি মালদ্বীপকে বয়কট করতে এবং ভারতীয় পর্যটন স্পটে যাওয়ার আহ্বান জানিয়ে পোস্টের পর পোস্ট করতে থাকেন। ‘#বয়কট মালদ্বীপ’ দ্রুত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি ট্রেন্ড হয়ে যায়। বোঝা যাচ্ছিল, অনলাইনের এ শব্দযুদ্ধের প্রভাব সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বাইরেও পড়তে যাচ্ছে।
পর্যটন হলো মালদ্বীপের বৃহত্তম শিল্প। এটি তার জিডিপির ২৮ শতাংশ এবং বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের ৬০ শতাংশ জোগান দেয়। মালদ্বীপের পর্যটন মন্ত্রণালয় প্রকাশিত সাম্প্রতিক তথ্য অনুসারে, গত বছর ১৮ লাখ বিদেশি পর্যটক মালদ্বীপে গিয়েছিলেন; এর মধ্যে ১১ দশমিক ২ শতাংশ ছিল ভারতের। তার পর ছিল রাশিয়া (১১.১ শতাংশ) এবং চীন (১০ শতাংশ)।
এখন পর্যন্ত একটি প্রধান অনলাইন ভ্রমণ বুকিং পোর্টাল ইজমাই ট্রিপ মালদ্বীপে ফ্লাইট টিকিট বিক্রি স্থগিত করেছে। ইন্ডিয়ান চেম্বার অব কমার্সের (আইসিসি) এভিয়েশন অ্যান্ড ট্যুরিজম কমিটির একটি বিবৃতিতে পর্যটন বাণিজ্য সংস্থাগুলোর প্রতি ‘মালদ্বীপের মন্ত্রীদের ভারতবিরোধী মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে মালদ্বীপের প্রচার বন্ধ করা’র আহ্বান জানানো হয়েছে। এটি বিমান সংস্থাগুলোকে মালদ্বীপে কার্যক্রম স্থগিত করারও আহ্বান জানিয়েছে। যদিও এখন পর্যন্ত ভারতীয় বিমান সংস্থাগুলো মালদ্বীপে ফ্লাইট আগের মতোই রেখেছে, তবে বিতর্ক শুরু হওয়ার পর বুকিং কমে গেছে বলে জানা গেছে।
মজার বিষয় হলো, সংকট শুরু হওয়ার পর লাক্ষা দ্বীপ সম্পর্কে অনলাইনে অনুসন্ধান বেড়েছে।
দশকের পর দশক ধরে ভারত-মালদ্বীপের সম্পর্ক শক্তিশালী ছিল। পারস্পরিক অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা সহযোগিতা বেড়েছে; মালদ্বীপের হাজার হাজার নাগরিক ভারতে পড়াশোনা করেছেন এবং চিকিৎসার জন্য সে দেশে এসেছেন। ১৯৮৮ সালে একটি অভ্যুত্থান চেষ্টার সময়, ২০০৪ সালে ভারত মহাসাগরের সুনামি, ২০১৪ সালে মালদ্বীপে পানি সংকট বা কভিড-১৯ মহামারিতে ভারত ছিল প্রথম সাড়া দানকারী।
সম্পর্কের টানাপোড়েন শুরু হয় ২০১৩-১৮ সালে, যখন প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ ইয়ামিনের অধীনে মালদ্বীপের পররাষ্ট্রনীতি স্পষ্টভাবে চীনের দিকে হেলে পড়ে। সদ্য সাবেক প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম সোলিহের অধীনে এই ঝোঁক সংশোধন করা হয়, যিনি ‘ভারত প্রথম’ পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করেছিলেন। এটি বিরোধীদের নেতৃত্বাধীন ‘ইন্ডিয়া আউট’ প্রচারে ইন্ধন জোগায়। নির্বাচনী প্রচারণার সময় মুইজ্জু মালদ্বীপে ভারতীয় সেনাদের দ্বীপপুঞ্জ থেকে বের করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভারতবিরোধী মনোভাবের আগুনে ঘি ঢেলে দেন।
নভেম্বরে অভিষেকের পর মুইজ্জু মালদ্বীপ থেকে তাঁর সামরিক কর্মীদের প্রত্যাহারের জন্য ভারতের প্রতি আহ্বান জানাতে থাকেন। তাঁর সরকার ভারতের সঙ্গে ২০১৯ সালে সম্পাদিত একটি হাইড্রোগ্রাফিক সমীক্ষা চুক্তি নবায়নের বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত নেয়। প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রথমে ভারত সফরের পূর্বসূরিদের রীতি ভেঙে মুইজ্জু প্রথম সরকারি সফর করেন তুরস্কে। তিনি এ পর্যন্ত নয়াদিল্লিকে উপেক্ষা করেছেন।
ভারতের কাটা ঘায়ে লবণ ছিটিয়ে, এমনকি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কাদা ছোড়াছুড়ি চলাকালেই মুইজ্জু চীনে চলে যান। তিনি চীনাদের মালদ্বীপে পর্যটক সংখ্যা বাড়াতে বলেছেন বলে জানা গেছে। তাঁর বর্তমান বেইজিং সফরে বেশ কিছু বিনিয়োগ ও অন্যান্য চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
এটা বলা যায়, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চলমান এ কাজিয়ার কারণে সৃষ্ট সংকটের দায় মোদি বা মুইজ্জু কেউই এড়াতে পারেন না। মুইজ্জু মালদ্বীপে ভারতবিরোধী মনোভাব জাগানোর জন্য দোষী হলেও তাঁর সমালোচকদের ট্রোল করা থেকে সমর্থকদের লাগাম টেনে ধরার জন্য তেমন কিছুই করেননি মোদি। অতএব বলা যায়, সর্বশেষ ভারত-মালদ্বীপ কূটনৈতিক সংকটের ক্ষেত্র
সূত্রঃ সমকাল
[sharethis-inline-buttons]
আপনার মতামত লিখুন :