• ঢাকা
  • বুধবার, ৮ই অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ২৩শে আশ্বিন, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ১০ সেপ্টেম্বর, ২০২৫
সর্বশেষ আপডেট : ১০ সেপ্টেম্বর, ২০২৫
Designed by Nagorikit.com

যৌতুক প্রথা: সমাজের এক ভয়াবহ ব্যাধি

কুমিল্লা জার্নাল
[sharethis-inline-buttons]


যৌতুক প্রথা আমাদের সমাজের জন্য এক ভয়াবহ অভিশাপ। মূলত হিন্দু সমাজে প্রচলিত পণপ্রথা থেকে এটি উদ্ভূত হলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এটি বাধ্যতামূলক এবং শাস্তিযোগ্য কুপ্রথায় পরিণত হয়েছে। হিন্দু আইনে কন্যাসন্তান পিতার সম্পত্তিতে অংশ পায় না। ফলে বিয়ের সময় কন্যাকে টাকা, গয়না বা অন্যান্য মূল্যবান সামগ্রী প্রদান করা হতো। কিন্তু সময়ের পরিবর্তনে এ প্রথার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য পরিবর্তিত হয়ে যৌতুক নামে একটি সামাজিক ব্যাধি হিসেবে রূপ নিয়েছে। বর্তমানে এটি পিতা-মাতার আশীর্বাদ থেকে বাধ্যতামূলক প্রথায় পরিণত হয়েছে।

আমাদের চারপাশে দেখা যায়, বিয়ের সময় বা পরে যৌতুকের জন্য নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে। অনেক সময় এটি মৃত্যুর মতো ভয়াবহ পরিণতিতে পৌঁছায়। যৌতুকের কারণে সংসারে অশান্তি সৃষ্টি হয়, অনেক সময় সংসার ভেঙে যাওয়ার উপক্রম বা ভেঙেও যাচ্ছে। এই ব্যাধি সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করেছে। গ্রাম থেকে শহর, নিম্নবিত্ত থেকে উচ্চবিত্ত—সর্বত্রই যৌতুকের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।

গ্রামে যৌতুক প্রথা তুলনামূলকভাবে প্রকাশ্য। সেখানে বলা হয়, যৌতুক না দিলে মেয়ের বিয়ে হবে না। কনের বয়স বেশি হলে যৌতুকের পরিমাণও বৃদ্ধি পায়। গ্রামের পরিবারগুলো প্রথাগতভাবে মনে করে, যৌতুক দিলে মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে সম্মান বজায় থাকবে। বরের পরিবারও যুক্তি দেয় যে, ছেলে মানুষ করতে তাদের অনেক খরচ হয়েছে, তাই যৌতুক তাদের প্রাপ্য। এই প্রথার ফলে গ্রামে মেয়েদের পরিবার ঋণগ্রস্ত হয় এবং অনেক সময় নারী নির্যাতন ঘটে।

শহরে যৌতুক প্রথা অনেকটা সূক্ষ্ম ও আড়ালকৃত। এখানে উচ্চবিত্ত পরিবারগুলো গাড়ি, ফ্ল্যাট, ব্যাংক ব্যালেন্স বা অন্য মূল্যবান উপহার আড়াল করে যৌতুক প্রদান করে। শহরে যৌতুক সরাসরি প্রকাশিত না হলেও সম্পর্কের ভিত্তি দুর্বল করে এবং সামাজিক চাপ সৃষ্টি করে। উদাহরণস্বরূপ, কুমিল্লা শহরের এক বিয়েতে দেখা গেছে, কনের পরিবার জানাল না, বরপক্ষ নগদ অর্থ ও গাড়ি প্রদান করেছে। শহরে যৌতুক নানা কৌশল ও ‘ফরম্যাটে’ দেওয়া হয়, যা সামাজিক নিয়মের আড়ালে ঘটে।

যৌতুকের কারণে সমাজে নানা সমস্যা দেখা দেয়। এটি নারীর প্রতি অন্যায় আচরণকে প্ররোচিত করে, দাম্পত্য কলহ ও বিবাহ বিচ্ছেদ বৃদ্ধি করে। দরিদ্র পরিবার ঋণগ্রস্ত হয়, আর ধনী পরিবারে ভোগবাদী মনোভাব বৃদ্ধি পায়। এটি দারিদ্র্য, বাল্যবিবাহ এবং অপরাধ প্রবণতা বাড়িয়ে দেয়। ফলশ্রুতিতে সামাজিক মর্যাদা ও নৈতিকতা ক্ষুণ্ণ হয়।

আইন এ ক্ষেত্রে স্পষ্ট। যৌতুক নিরোধ আইন, ২০১৮ অনুযায়ী, যৌতুক প্রদান বা গ্রহণ, কিংবা যৌতুকের জন্য প্ররোচনা দেওয়া সকলকেই ৫ বছরের কারাদণ্ড বা জরিমানা বা উভয়দণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। এটি মৌখিক বা লিখিত যেকোনো রূপে হতে পারে। মিথ্যা মামলা দায়ের করলেও সর্বাধিক পাঁচ বছরের কারাদণ্ড বা অর্থদণ্ড ধার্য করা হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি চাইলে সালিশ বা আপোষের মাধ্যমে সমস্যার সমাধান পেতে পারেন, অথবা আদালতে মামলা দায়ের করতে পারেন। বর্তমানে বাংলাদেশে কিছু সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা রয়েছে, যারা যৌতুকের কারণে ক্ষতিগ্রস্তদের বিনামূল্যে আইনি সহায়তা প্রদান করে। এর মধ্যে বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড এন্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (BLAST), আইন ও সালিশকেন্দ্র (ASK) এবং বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতি উল্লেখযোগ্য।

যৌতুক প্রথা আমাদের সমাজের জন্য এক অভিশাপ। গ্রাম হোক বা শহর, দরিদ্র হোক বা উচ্চবিত্ত, সর্বত্র এটি বিদ্যমান। নারীর অধিকার ক্ষুণ্ণ হচ্ছে, পারিবারিক শান্তি বিনষ্ট হচ্ছে, আর সামাজিক নৈতিকতা ক্ষয়ে যাচ্ছে। তবে আইন, সামাজিক সচেতনতা, শিক্ষার প্রসার এবং পারিবারিক মূল্যবোধের সমন্বয়ে আমরা যৌতুকমুক্ত সমাজ গড়ে তুলতে পারি। প্রতিটি পরিবারকে দৃঢ়ভাবে বলতে হবে—“যৌতুক নয়, শিক্ষা ও গুণই বিয়ের আসল সম্পদ।”

মোহাম্মদ জামাল হোসেন, প্রধান শিক্ষক, চৌদ্দগ্রাম মাধ্যমিক পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়

[sharethis-inline-buttons]

আরও পড়ুন

  • অন্যান্য এর আরও খবর