স্টাফ রিপোর্টার।।
কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের প্রধান সহকারি দেলোয়ার হোসেন। সাবেক এমপি হাজী আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহারের অন্যতম পচ্ছন্দের লোক হিসেবে পরিচিত দেলোয়ার হোসেন ২২ বছর ধরে কুমেক হাসপাতালে আধিপত্য বিস্তার করে যাচ্ছেন। বলতে গেলে একক আধিপত্যে নানা অনিয়মকে নিয়মে পরিণত করেছেন এই দেলোয়ার। ৫ আগষ্ট আওয়ামী সরকারের পতন হলেও দেলোয়ার রয়েছেন বহাল তবিয়তে। এখনো তার ক্ষমতার প্রভাব একটুও কমেনি। দেলোয়ারের নেতৃত্বে আওয়ামী সিন্ডিকেট এখনো সক্রিয় কুমেক হাসপাতালে।
জানা যায়, দেলোয়ার হোসেন শরিয়তপুর জেলার সখিপুর গ্রামের নুরুল ইসলামের ছেলে । ১৯৯২ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত অধ্যবদি এই কুমেক হাসপাতালে তিনি চাকরি করে যাচ্ছেন। জানা গেছে, ১৯৯২ সালে দেলোয়ার হোসেন কুমেক হাসপাতালে ক্যাশিয়ার পদে চাকরি শুরু করেন। ক্যাশিয়ার পদটির পদোন্নতি অযোগ্য। হিসাব রক্ষক বা উচ্চমান সহকারি পদ থেকে জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে প্রধান সহকারি পদে বদলি হওয়ার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু ক্যাশিয়ার পদ থেকে অন্য কোন পদে পদোন্নতি হওয়ার সুযোগ নেই। তবে দেলোয়ারের বেলায় চাকরিবিধি ভঙ্গ করে ২০১৪ সালের ১৩ নভেম্বর অবৈধভাবে তাকে প্রধান সহকারি পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়। তিনি ক্যাশিয়ার থাকাকালিন সময় থেকেই হাসপাতালের ডক্টরস কোয়ার্টার ব্যবহার শুরু করেন। প্রায় ৫ বছর তিনি তা ব্যবহার করেন।
দাপ্তরিকভাবে দেলোয়ার হোসেন কুমেক হাসপাতালের প্রধান সহকারি হলেও তিনি অঘোষিতভাবে হাসপাতালের আরো দুটি পদ দখল করে আছেন। তিনি সরকারি চাকরিবিধি ভঙ্গ করে হয়েছেন প্রধান সহকারি। পাশাপাশি তার নিয়ন্ত্রণে রয়েছে হাসপাতালের হিসাব রক্ষক ও ক্যাশিয়ার পদটিও। অনিয়ম ও দুর্ণীতির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা লোপাটের অভিযোগ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তদন্তে প্রমাণিত হলেও দেলোয়ার তার ক্ষমতায় অটুট ছিলেন।
স্থানীয় সূত্র জানায়, কুমিল্লায় তার দীর্ঘ ২২ বছর চাকরি জীবনে অনিয়ম করে টাকা উপার্জন করে তার নিজ জেলা শরিয়তপুর ও কুমিল্লার চাপাপুর মৌজায় ৯টি জমির দলিলের হিসেব অনুযায়ী বেশ কয়েক কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন তিনি। এর মধ্যে দুদক কুমিল্লা অফিসের ১০০ গজ দক্ষিণে রয়েছে দেলোয়ারের ৬ তলা বিলাসবহুল ভবন (২৪ ইউনিট)। যদিও এই ভবনের কয়েকটা শেয়ার রয়েছে।
কুমেক সূত্র আরো জানায়, দেলোয়ার হোসেনের স্ত্রী মাহমুদা আক্তার একজন স্কুল শিক্ষিকা। এদিকে ২০০৭ সালে মাহমুদা আক্তার নামের একজন সিনিয়র স্টাফ নার্স হিসেবে কুমিল্লা মেডিকেল হাসপাতালে বদলি হয়ে আসেন। ওই সিনিয়র নার্স স্টাফকে নিজের স্ত্রী পরিচয় দিয়ে দেলোয়ার হোসেন তার মেয়ে কাবনুর বিনতে কবিরকে ওই বছর কুমিল্লা ফয়জুন্নেসা বালিকা সরকারি বিদ্যালয়ে নবম শ্রেণিতে ভর্তি করানোর জন্য আবেদন করেন। নিজের স্ত্রীর নামের সাথে নার্সের নামের মিল থাকায় অবৈধভাবে তা ব্যবহার করেন দেলোয়ার।
স্থানীয় সূত্র আরো জানায়, নিয়ম অনুযায়ী কুমেক হাসপাতালের ভিতরে একটি ঔষুধের দোকান থাকার কথা থাকলেও বর্তমানে সেখানে তিনটি দোকান রয়েছে, যা নীতিবর্হিভূত। এই দোকানগুলো দেলোয়ারের ইশারায় চলছে।
জানা যায়, ২০২০ সালের ২২ অক্টোবর মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের প্রশাসন-১ অধিশাখার উপসচিব জাকিয়া পারভীন হাসপাতালের পরিচালকের উদ্দেশ্যে একটি চিঠি দেন। কুমেক হাসপাতালে ওই সময় ভারপ্রাপ্ত পরিচালক হিসেবে ছিলেন ডা. মো. মাহবুব আলম। চিঠিতে প্রধান সহকারি দেলোয়ার হোসেনের বিরুদ্ধে বিভাগীয় অথবা ফৌজদারি মামলা করতে আদেশ দেয়া হয় এবং উক্ত হাসপাতালের প্রশাসনিক ও আর্থিক কর্মকান্ড থেকে বিরত রাখার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হয়। কিন্তু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে কোন ধরনের পদক্ষেপ নেননি।
২০২০ সালে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর তার ব্যাপক অনিয়ম-দুর্ণীতি ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের প্রমাণ পেয়ে ১ মার্চ তাকে স্ট্যান্ড রিলিজ করে চট্টগ্রাম বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে যোগদান করতে ৩ কার্যদিবস সময় বেঁধে দেন। কিন্তু দেলোয়ার হোসেন অধিদপ্তরের মহা পরিচালক, স্বাস্থ্য সচিবসহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালে মামলা করে তার বদলির আদেশ স্থগিত করেন। ওই সময় কুমেক হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও তার বিরুদ্ধে কোন ধরনের পদক্ষেপ নেননি।
২০১৯ সালের ১৭ নভেম্বর ঢাকা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন) ডা. মো: বেলাল হোসেন স্বাক্ষরিত বিভাগীয় মামলার অভিযোগনামাতে উল্লেখ্য করা হয়, মোঃ দেলোয়ার হোসেন ১৯৮৫ সনের নিয়োগ বিধি লংঘন পূর্বক ক্যাশিয়ার পদ হতে প্রধাণ সহকারি পদে পদোন্নতি নেন। প্রতি অর্থ বৎসরে বিভিন্ন খাত হতে বিভিন্ন প্যাডের মাধ্যমে ক্রয় মেরামত বাবদ ভুয়া বিল ভাউচারের মাধ্যমে ২০/৩০ লক্ষ টাকা আত্মসাৎ করেন। হাসপাতালের কফি হাউজের বিদ্যুৎ বিলের টাকা আত্মসাৎ করে।প্রতি বৎসর সিসি ক্যামেরা ও ইন্টারকম মেরামত বাবদ বিল ভাউচারের মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নেয় দেলোয়ার হোসেন। এছাড়া প্রধান সহকারি হয়ে বিল ভাউচার তৈরী করা এবং হিসাব রক্ষক হয়ে বিল ভাউচার পাশ করা ও ক্যাশিরার হয়ে টাকা উত্তোলন করা অর্থাৎ তিনটি পদের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। তাছাড়া এসি/ কম্পিউটার/ইন্টারকম/অন্যান্য মেরামত বাবদ প্রায় ২-২.৫ লক্ষ টাকা আত্মসাৎ করেন দেলোয়ার। এছাড়া নিজ জেলা শরিয়তপুর ও কুমিল্লায় কিছু জায়গা জমি ক্রয় এবং কুমিল্লা শহরে ফ্লাট ক্রয় করার অভিযোগসমূহ তদন্তে প্রমাণিত হয়েছে।
দুদকে দেলোয়ারের বিরুদ্ধে অভিযোগ হলেও সেখান থেকে সে পরিত্রান পায়।
কুমেক হাসপাতালের কোন চাকরিজীবিই তার ভয়ে কথা বলতে চান না।
এ বিষয়ে কুমেক হাসপাতালের প্রধান সহকারি দেলোয়ার হোসেন জানান, এসব অভিযোগ মিথ্যে। আমার বিরুদ্ধে অতীতে যা অভিযোগ করা হয়েছে, তার সমাধান হয়ে গেছে।
এ বিষয়ে জানতে কুমেক হাসপাতালের পরিচালক ডা. মাসুদ পারভেজের মুঠোফোনে একাধিকবার কল দিলে সংযোগ পাওয়া যায়নি।
[sharethis-inline-buttons]
আপনার মতামত লিখুন :